পড়ুয়া প্রোজেক্ট – শিশুদের হাতে বই তুলে দেয়ার জন্যই যার শুরু

আমরা যখন শিক্ষা নিয়ে কাজ করবো সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম ২০১৫ সালে, তখন আমাদের প্রশ্ন ছিল – শিক্ষা এতো বড় একটা বিষয় যেটা নিয়ে সারাজীবন কাজ করলেও শেষ হবার নয়।

একজন নতুন উদ্যোগক্তা হিসাবে আমার ক্ষমতা খুব স্বল্প। আমি চাইলেও অনেক ধরনের কাজ করতে পারবো না। তাহলে আমার কাছে যদি ১০০ টাকা থাকে তাহলে কোন জায়গায় সেই টাকাটা ইনভেস্ট করা দরকার যেখানে সর্বোচ্চ রিটার্ন অন ইনভেস্টমেন্ট পাবো? আমার জন্য না, সমাজের জন্য। দেশের জন্য। 

প্রাইমারি শিক্ষার মধ্যেও তো অনেক ধরনের কাজ করা যায়। কিন্তু কোন বিষয়ে কাজ করলে সর্বোচ্চ রিটার্ন অন ইনভেস্টমেন্ট পাওয়া যাবে?

সেটা নিয়ে গবেষণা করতে গিয়েই বের হল যে যদি আমরা শিশুদের মধ্যে রিডিং স্কিল ইম্প্রুভ করতে পারি, তাহলে সবচেয়ে বেশি রিটার্ন পাওয়া যায়। আর সেটা করার জন্য সবচেয়ে সহজ ও কার্যকরী উপায় হচ্ছে তাদের হাতে গল্পের বই তুলে দেয়া।

বাংলাদেশের সব শিশুরা ক্লাস ৫ এর আগেই যদি বাংলাতে ঠিকমতো তার গ্রেড অনুযায়ী রিডিং পড়তে পারে, সেটা দেশের জিডিপি বাড়াতে সরাসরি ইমপ্যাক্ট করে।

যদি কেউ ১০০ টাকা খরচ করে শিশুদের হাতে বই তুলে দিতে, সেটা থেকে ৪৭০০% রিটার্ন আসে লাইফটাইমে, যেটা বাংলাদেশের জিডিপিতে ইমপ্যাক্ট করবে। পৃথিবীতে এর চেয়ে ভালো ইনভেস্টমেন্ট আর কিছু আছে বলে আমার জানা নেই।

লাইট অফ হোপ থেকে তাই ২০১৫ সালের মে মাস থেকে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম বিভিন্ন স্কুলে স্কুলে লাইব্রেরি করে দিবো। সেখানে শিশুদের বয়স উপযোগী বিভিন্ন থিমের বই দিবো।

প্রথমে নিজেদের সেভিংস থেকে, এরপর বন্ধুদের সহায়তায় ফান্ড কালেক্ট করে আমরা বিভিন্ন স্কুলে লাইব্রেরি করা শুরু করলাম। যখন এভাবে ৫০টি লাইব্রেরি হয়ে গেলো, তখন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও এগিয়ে আসতে লাগলো।

আমরা ঢাকার বিভিন্ন স্কুলে ক্যাম্পেইন করে পুরাতন বই সংগ্রহ করতে লাগলাম। পাশাপাশি বিভিন্ন প্রকাশকদের কাছ থেকে স্বল্পমুল্যে বই কিনে এক একটা স্কুলের জন্য ২০০-২৫০ বইয়ের একটা করে লাইব্রেরি করে দিতে লাগলাম।

কেন ২০০ বই? কারণ একটা শিশু একটা একাডেমিক বছরে ৪০টি সপ্তাহ পায়। যদি সে প্রতি সপ্তাহে একটা করে বই পড়ে, তাহলে পুরো ৫ বছরে সে ২০০টি বই পড়ার সুযোগ পাবে। আর সেই বইগুলো যেহেতু আমরা বিভিন্ন থিমে বাছাই করি, তাই রিডিং স্কিল বাড়ার পাশাপাশি তার মধ্যে নৈতিকতা, মূল্যবোধ, সৃজনশীলতা, বিজ্ঞানমনস্কতা তৈরি হবে, বাংলাদেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতি ইত্যাদি বিষয়ে ধারণা হবে। এবং সে একজন আদর্শ নাগরিক হিসাবে গড়ে উঠবে। 

এই ধারণা থেকেই যাত্রা শুরু হয় আমাদের ‘পড়ুয়া’ নামের উদ্যোগের। ২০২০ সালে করোনার আগে স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত ‘পড়ুয়া’ উদ্যোগের মাধ্যমে আমরা বাংলাদেশের ২৪টি জেলায় ৫০০+ স্কুলে দেড় লক্ষ বই দিয়ে লাইব্রেরি করে দেই। এর মাধ্যমে ২ লক্ষর বেশি শিশু সরাসরি উপকৃত হতে থাকে। এর মাধ্যমে ‘পড়ুয়া’ হয়ে উঠে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ভলান্টারি উদ্যোগগুলোর একটি।   

করোনার পর আবার ২০২২ সালে আমরা পড়ুয়ার কাজ শুরু করার উদ্যোগ নেই। এবং আমাদের সাথে যুক্ত হয় সাজিদা ফাউন্ডেশন। তাদের সহায়তায় ১১টি জেলায় ১০২টি সরকারি প্রাইমারি স্কুলে আমরা লাইব্রেরি করে দেই ২০২৩ সালে।

আর এর মাধ্যমে একই সাথে ১০২টি স্কুলে ২৫,০০০ এর বেশি বই দিয়ে একবারে লাইব্রেরি করার মাধ্যমে নতুন এক রেকর্ড তৈরি করে পড়ুয়া। আর শুরু হয় পড়ুয়ার নতুন ফেজ। শিশুদেরকেই প্রশিক্ষণ দিয়ে দেয়া হয়, যেন তারা তাদের স্কুলের লাইব্রেরি নিজেরাই ম্যানেজ করতে পারে। পাশাপাশি আলাদা একটা তহবিল করা হয় যেন পরের বছর কিছু বই ছিঁড়ে গেলে, নষ্ট হয়ে গেলে, নতুন বই কিনে দেয়া যায়।

আমাদের নতুন লক্ষ্য আমরা ঠিক করেছি। আগামী ১০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের সবগুলো স্কুলে ২০০-২৫০টি বই দিয়ে একটা ছোট্ট লাইব্রেরি করে দেয়া। সেই লক্ষ্যে আমরা এখন কাজ শুরু করেছি।

আমাদের প্রয়োজন হবে মোট ২ কোটি বই। এই বইগুলোর কিছু আমরা স্কুল ক্যাম্পেইন করে সংগ্রহ করবো, কিছু পুরাতন বইয়ের দোকান থেকে কিনবো, একটা বড় অংশ আমরা বিভিন্ন প্রকাশক থেকে স্বল্প মূল্য কিনবো।

শুরু থেকেই একটা বড় সাপোর্ট আমরা ব্যক্তিগত পর্যায় থেকেই পেয়েছি। দেশ ও দেশের বাইরে থেকে অনেকেই বই কেনার জন্য, শেলফ বানানোর জন্য আমাদের ব্যক্তিগতভাবে সহায়তা করেছেন।

পাশাপাশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত হয়ে আমরা ফান্ড সংগ্রহ করেছি, অনেক ক্ষেত্রে ইন-কাইন্ড সাপোর্ট পেয়েছি।

যারা শিশুদের হাতে বই তুলে দেয়ার এই কাজে যুক্ত হতে চান, তারা আরও জানতে ভিজিট করুন

ধন্যবাদ

ওয়ালিউল্লাহ ভূঁইয়া